কি হয়েছিল সেই রাতে ? শেষ পর্যন্ত না পড়লে বুঝতে পারবেন না।
শহরের আলো থেকে অনেক দূরে, কুয়াশায় ঢাকা এক উপত্যকা— নাম তার অরুণপুর। এই উপত্যকার উত্তর-পশ্চিমে আছে এক পুরনো রেলসেতু, যেটা দিয়ে বহু বছর ট্রেন আর চলে না। লোহার পাটাতনে মরচে, নিচে নদীর ধূসর জল, ওপরে শীতের কাঁপুনি ধরা বাতাস। পূর্ণিমার রাতে মানুষ বলে— সেখানে সময় অন্যরকম ভাবে বয়ে যায়; কণ্ঠস্বরগুলো কাছে আসে, দূরে যায়, আবার ফিরে আসে নিজের নাম ধরে।
ঋদ্ধির জীবনে এই উপত্যকা আসে এক শীত-শেষের সন্ধ্যায়। শহর ছাড়তে সে একরকম বাধ্যই হয়েছিল— চাকরি গেল, সম্পর্ক ভেঙে গেল, আর একটি না-ফেরা ফোনকলের ওপাশে পড়ে রইল তার ভালোবাসার নাম: ঐশী। মানুষ যখন বুঝতে পারে যে শহরের ভিড়েও সে একা, তখন সে দূরের কোনো পাহাড়, নদী বা বনের নাম মনে রাখে— ঋদ্ধির জন্য সেই দূরের নাম ছিল অরুণপুর। “এখানে কেউ আমাকে চেনে না,” সে নিজেকে বোঝাল, “তাই হয়তো আমি নিজেকেও নতুন করে চিনতে পারব।”
অরুণপুরে তাকে উঠতে দিলেন স্থানীয় স্কুলশিক্ষক, বিমলবাবু। ছোট একটি কক্ষ, কড়িকাঠে তেলের গন্ধ, মেঝেতে মাদুর। প্রথম রাতেই বিমলবাবু বললেন, “পূর্ণিমার পরে সেতুর দিকে যেও না— ওইখানে সময়টা একটু ভুলে যায়।” ঋদ্ধি হাসল, “সময় ভুলে গেলে মানুষ লিখতে শেখে।” বিমলবাবু তাকালেন জানালার অন্ধকারে, “লেখা শিখতে গিয়ে অনেকেই ফিরে আসতে শেখে না।”
ঋদ্ধির লেখা শুরু হল গ্রামের গল্প নিয়ে— নিখোঁজ হওয়া মেয়ের পুরনো কাহিনি, নদীর গা ঘেঁষে হাঁটা শালবনের বুনো গন্ধ, আর সেতুর ওপরে শোনা নামডাকার মায়া। লোকেরা বলে, সাত বছর আগে পূর্ণিমার রাতে এক তরুণী— মায়া— ওই সেতুতে দাঁড়িয়ে কারও অপেক্ষা করছিল। যে ‘কারও’ নাম শুনলে তার চোখে আলো জ্বলত, সেই মানুষটি সে রাতে আসেনি। পরদিন থেকে মেয়েটিকে আর কেউ দেখেনি। তারপর থেকে, নির্দিষ্ট রাতগুলোতে, নিজের ভেতরের ভয় যাদের ভারী করে রাখে— তারা নাকি নিজেদেরই নাম শুনতে পায়।
ঋদ্ধি এসব কথা নোটবুকে টুকে রাখে— কিন্তু প্রতি রাতেই, ঘুম পাড়ানি বাতাস যখন জানালার কাচে এসে নরম ঠান্ডা রেখে যায়, তখন ভাপ ওঠা কাচে নিঃশ্বাস দিয়ে সে দেখতে পায় এক লাইন— “তুমি দেরি করেছ।” কখনও কেউ লিখে দেয় না; তবু লেখাটা থাকে। সে আঙুল দিয়ে মুছে দেয়। আবার ফিরে আসে লেখাটি, অক্ষরগুলো মাজাঘষা স্মৃতির মতো— অস্পষ্ট, তবু জেদি।
ঋদ্ধি জানে— দেরি করেছিল সে-ই। ঐশীর সঙ্গে তার শেষ দেখা, শেষ চা, শেষ ঝগড়া— সবকিছুতেই সে দেরি করেছে। ক্ষমা চাইতে দেরি; নিজের ভুল স্বীকার করতে দেরি; এমনকি “থাকো” বলতেও দেরি। ঐশী বলেছিল, “ভালোবাসা সময়ের কাছে হার মানে না, তবে মানুষের কাছে মানে।” ঋদ্ধি চুপ করে ছিল। পরদিন ঐশী ট্রেনে চড়ে চলে যায়। আর সেই থেকে, নিজের নাম কখনও কখনও অচেনা কণ্ঠে শুনতে পায় ঋদ্ধি— যেন ভাঙা কাঁচে নিজের মুখ দেখা।
এক রাত, শীতের কুয়াশা একটু পাতলা। দূরে সেতুর দিকে ধাতব গন্ধ— মরিচা, জল, বাতাস। ঋদ্ধি টর্চ নিয়ে হাঁটতে থাকে। রেললাইনের কাঠের স্লিপারগুলোর ফাঁকে ফাঁকে থিতিয়ে আছে পানির আস্তরণ। মাঝসেতুতে পৌঁছে টর্চ নিভিয়ে দেয়। হাওয়া এসে বলে— “ঋদ্ধি…”
সে চমকে ওঠে। এই কণ্ঠ সে চেনে না, তবু অকারণে চেনা লাগে— আমরা যে কণ্ঠগুলোকে মনে রাখি, তাদের শব্দ নয়, তাদের নীরবতাই আমাদের ধরে রাখে। কণ্ঠ আরও কাছে আসে— “তুমি কি বিশ্বাস করো?” ঋদ্ধি ধীরে বলে, “জানতে চাই।” কণ্ঠ বলে, “জানতে হলে নিজের ভেতরও শুনতে হয়।”
তারপরের দিনগুলোতে, যে কোনো কথাই ঋদ্ধির কানে এসে “ঐশী”-তে বাজে। বিমলবাবুর অনর্গল ইতিহাস, গ্রামের চায়ের দোকানে ঝাঁপির আওয়াজ, বিকেলের স্কুলছুটে বাচ্চাদের হাসি— সবকিছু কোনো এক অদৃশ্য রেজিস্টারে তার পুরনো প্রেমের নাম ধরে রাখে। রাতে পাতার কাঁপুনিতে সে শোনে— “ফিরে এসো।” জবাব দেয়— “আমি তো আছি।” তারপর আরেক কণ্ঠ— “নিজের কাছে ফিরবে?”
ঋদ্ধি ভাবে— মানুষ কেন হারিয়ে যায়? নদীতে ডুবে? শহরে চলে গিয়ে? নাকি নিজের ভিতরের কক্ষগুলোর মধ্যে পথ হারিয়ে? মায়ার কাহিনি শুনতে শুনতে সে আন্দাজ করে— হারানোর সবচেয়ে ক্ষুদ্র, তবু কষ্টদায়ক সংজ্ঞা হচ্ছে: “ভালোবাসা, যা আমরা দিতে পারতাম— কিন্তু দিইনি।”
এক সন্ধ্যায় গ্রামের প্রান্তে বসে থাকা এক বৃদ্ধা বললেন, “সেতুতে যারা যায়, তারা নিজের নাম শুনতে পায়। নাম তো বাইরে থেকে ডাকে না— ভেতর থেকেই ওঠে। ভেতরের ডাক যখন বাইরে পৌঁছায়, তখন মানুষ ভাবে— ওটা অশরীরী কিছু।” ঋদ্ধি জিজ্ঞেস করল, “মায়ার কী হয়েছিল?” বৃদ্ধা আকাশে পূর্ণিমার দাগ দেখে বললেন, “কেউ জানে না। কেউ বলে, সে নেমেছিল; কেউ বলে, সে উঠে গিয়েছিল। আমি বলি— সে অপেক্ষাতেই রয়ে গেছে।”
রাত বারোটার পর সেতুতে ফেরার পর ঋদ্ধি বুঝল— অপেক্ষারও রঙ আছে। কিছু অপেক্ষা নীল— আকাশের মতো খোলা; কিছু অপেক্ষা ধূসর— কুয়াশার মতো অনিশ্চিত; আর কিছু অপেক্ষা লাল— রক্তজবা ফুলের মতো টনটনে, যা সময়কে আটকে দেয়। সেদিনের কণ্ঠ বলল, “ভয়কে চিনতে চাও?” ঋদ্ধি জিজ্ঞেস করল, “ভয় কি মানুষকে ডাকে?” কণ্ঠ বলল, “ভয় মানুষকে নিজের নাম ধরে ডাকে— যাতে মানুষ জানে, সে একা আছে; তারপর সে খুঁজতে বেরোয়— নিজের মতো আর একজনকে। খুঁজতে গিয়ে বোঝে, সে আসলে নিজেকেই খুঁজছিল।”
ঋদ্ধি ঐশীকে লিখতে বসে— চিঠির ভেতর ক্ষমা চাইতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সে জানে না, চিঠি যাবে কোথায়। শহরে ঐশী আছে কি নেই, কার সঙ্গে আছে, কেমন আছে— কিছুই তার জানা নেই। তবু চিঠি লেখে, তারপর ভাঁজ করে রাখে নোটবুকের প্রথম পাতায়; হয়তো কোনোদিন পোস্ট করবে না— কিন্তু চিঠির অস্তিত্বটাই তাকে বাঁচিয়ে রাখে।
অরুণপুরের গল্প ধীরে ধীরে অন্যদিকে মোড় নেয়— আরিয়ান নামের এক যুবকের প্রসঙ্গ ওঠে, যে নাকি শহর থেকে এসে ক্যানভাসে গ্রামের নদী আঁকত। বলে, মায়ার সঙ্গে তার প্রেম ছিল। পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনার দিনেই আরিয়ান নাকি অসুস্থ মায়ের কাছে ফিরে যায়, খবর পৌঁছাতে পারে না। মায়া অপেক্ষা করে, সেতুর মাথায় দাঁড়িয়ে। পূর্ণিমা ওঠে। নদীর ওপরে ধোঁয়া ওঠে। কোনো এক কণ্ঠ— হয়তো আরিয়ানের মতো, হয়তো মায়ার নিজস্ব ভয়— বলে দেয়: “ফিরে যা।”
ঋদ্ধি বুঝতে পারে— ভালোবাসা কখনও কখনও সময়ের কাছে নয়, বরং ভুল বোঝাবুঝির কাছে হেরে যায়। মানুষ যা বলে, তার চেয়ে মানুষ যা বলতে পারেনি— তার দাম বেশি। মায়ার গল্পে বলা হয়নি এমন বহু কথা আছে— সেই অনুচ্চারিত শব্দগুলো রাতের কুয়াশায় ভেসে থাকে, সেতুর রেললাইনে ঝরে পড়ে, আর ভোরের আগে কেউ নোটবুকে তুলে রাখে।
একদিন রাতে, ঋদ্ধি ঠিক মাঝসেতুতে দাঁড়িয়ে নোটবুক খুলল। বাতাসে ধাতব গন্ধ একটু বেশি। নীরবতার ছায়ায় ভেসে উঠল এক তরুণী— কোনো ছায়ার মধ্যেই মানুষকে যতটা দেখা যায়, ততটাই দেখা গেল তাকে। সাদা শালের কিনারায় কুয়াশার পানি। সে বলল, “ভয় পেয়ো না। ভয়ই তো তোমাকে এখানে এনেছে। ভয় না থাকলে তুমি লিখতে না, লিখতে না— ক্ষমাও চাইতে।” ঋদ্ধি বলল, “তুমি কে?” মেয়েটি হেসে বলল, “আমি যে নামেই থাকি— আমার কাজ একই। আমি অপেক্ষা।”
সেই রাত থেকে, ঋদ্ধির ঘুম নরম হয়ে যায়। ভোরে উঠে সে দেখে জানালার কাচে নতুন লেখা— “ক্ষমা কী?” সে কাচ মুছে নিজের হাতেই লিখে রাখে— “ক্ষমা মানে গতকালের ভুলকে আজকে ভালোবাসা দিয়ে ঢেকে দেওয়া।” এই উত্তরের কোনো ঠিক-ভুল নেই; তবু তার বুক হালকা লাগে।
সময়ের মধ্যে ফিরে আসতে হলে মানুষকে কোনো এক পর্যায়ে নিজের কাছে সত্যি বলতে হয়— “আমি দেরি করেছি।” সেই সত্য বলার চেষ্টা করতেই, একদিন দুপুরে বাজারের দিকে ঐশীর মতো একটা মুখ দেখে থেমে যায় ঋদ্ধি। স্বাভাবিক, শহরের মুখগুলো গ্রামে ফিরেও আসতে পারে, কিন্তু এই মুখটি ঐশী নয়। তবু ঐ মুখ দেখে সে বুঝতে পারে— যে মানুষ চলে গেছে, তাকে ভুলে যাওয়া যায় না; কিন্তু তাকে মনে রাখার ভঙ্গিটা একটু বদলানো যায়।
অরুণপুর ধীরে ধীরে তার ভিতরের কক্ষগুলো খুলে দেখায় ঋদ্ধিকে— শ্মশানপারের নিস্তব্ধতা, নদীর জলে মিশে থাকা বৃষ্টির ধাতব স্বাদ, আর সেতুর ওপর দাঁড়ালেই মাথার ভেতর যে টনটনে শব্দ ওঠে— “ফিরে এসো।” কোনোদিন এই শব্দ অন্য কারও নামে বাজবে— এই ভয়ে ঋদ্ধি আর কণ্ঠকে তাড়ায় না। সে দাঁড়িয়ে থাকে, যতক্ষণ না কণ্ঠটি স্বর হারিয়ে বুঝিয়ে দেয়— ডাক আসলে বাইরে থেকে না, ভিতর থেকে।
অবশেষে, পূর্ণিমার রাত। গ্রামে আজ সবাই একটু তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে। কুয়াশা মোটা। সেতুর লোহার গায়ে ধাতব শিশির। ঋদ্ধি নোটবুক, কলম, আর পকেটে ভাঁজ করা চিঠি— সব নিয়ে চলে যায়। মাঝসেতুতে দাঁড়িয়ে সে চোখ বন্ধ করে। কোনো আলো নেই, তবু অদ্ভুত এক দৃশ্য সে ‘দেখতে’ পায়— নদীর ওপর ভাসছে তার নিজের নামে ডাকা কণ্ঠ। কণ্ঠটি বলছে, “তুমি কি ক্ষমা করেছ?” সে ভাবে— কাকে? ঐশীকে? নিজেকে? সময়কে? নাকি সেই রাতে যে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছিল— তাকে?
মেয়েটি— যে হয়তো মায়া, হয়তো ঐশীর স্মৃতির অর্ধেক, হয়তো কেবল অপেক্ষা— কাছে আসে। বলে, “ক্ষমা কখনও একবারে হয় না। ক্ষমা একধরনের রিপিটিশন— যতবার মনে পড়ে, ততবার ভালোবেসে নেওয়া।” ঋদ্ধি বলল, “তুমি কি ফিরে আসবে?” মেয়েটি মাথা নেড়ে বলল, “আমি থেকে গেছি— তোমার ভিতরের যে কক্ষে অপেক্ষা রাখা আছে, সেখানে। বাইরে থেকে আমার কোনো আগমন-প্রস্থান নেই।”
ঋদ্ধি এবার নোটবুক থেকে চিঠিটা বার করল— ঐশীর নামে লেখা। সেতুর রেললাইনের ফাঁকে দাঁড়িয়ে সে চিঠিটা উচ্চস্বরে পড়ে শোনাল— “আমি দেরি করেছি, আমি ভুল করেছি, আর আমি চাই— তুমি ভালো থাকো, আমার ছাড়া, আমার সাথে, যেভাবে খুশি।” তারপর চিঠিটা ভাঁজ করে পকেটে রাখল। পুড়িয়ে ফেলা বা জলে ভাসিয়ে দেওয়া— এসবের কোনোটা করতে মন চাইল না। চিঠি থাকুক— তাকে মনে করিয়ে দিতে যে, মানুষ ভুল করে, তবু লিখে ফেলতে পারলে ভোর একটু তাড়াতাড়ি আসে।
ভোরের একটু আগে, কুয়াশা পাতলা। নদীর উপর থেকে সাদা চাদরটা সরতে শুরু করেছে। ঋদ্ধি বুঝতে পারে— যে কণ্ঠ তাকে এতদিন ধরে “ফিরে এসো” বলে ডাকত, আজ সেই কণ্ঠই ধীরে ধীরে বলছে— “যেতে পারো।” যাওয়ার অনুমতিটাই আসলে ফিরে আসা।
শহরে ফেরার আগে বিমলবাবু বললেন, “তুমি কি বুঝেছ?” ঋদ্ধি বলল, “হ্যাঁ— ভয়কে নাম ধরে ডাকলে, ভয়ও মানুষকে নাম ধরে ডাকে। কিন্তু একসময় দুজনেই ক্লান্ত হয়। তখন ভয় আর মানুষ একসাথে বসে চা খায়— আর ভয় বলে, এবার তুই যা, আমি আছি।” বিমলবাবু হেসে বললেন, “লিখতে পারলে বাঁচা যায়। আর ভালোবাসতে পারলে— ফিরে এসে আবার লেখা যায়।”
শেষ নোট: অরুণপুরে পূর্ণিমা উঠলে এখনো কেউ কেউ নিজেদের নাম শোনে। কিন্তু ঋদ্ধি জানে— সেই ডাক আর বাইরে থেকে আসে না। ডাক আসে ভিতর থেকে, যেখানে অপেক্ষা একদিন ভালোবাসার জায়গা ছেড়ে দেয়। আর সেতুর ওপরে যদি কোনোদিন কেউ বলে— “তুমি দেরি করেছ”— ঋদ্ধি ধীরে জবাব দেয়, “আজ আমি সময়মতো এসেছি।”
❓ আজকের প্রশ্ন
“নামের ডাক” — গল্পে আসলে কোথা থেকে আসে? আপনার উত্তর লিখুন এবং একটি অপশন বেছে নিন।

